1. admin@theonlinenewsbangladesh.com : admin :
শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০৭ অপরাহ্ন
সাইট উন্নয়নের কাজ চলছে

ছোটদের গল্প; আবার সতেরো বছর পরে

Reporter Name
  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪
  • ২৬৪ Time View

প্রান্তিক বিশ্বাস

টিংটং! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বেলটা টিপল ও। টিংটং। আবারও মিনিটখানেকের অপেক্ষা। এবার অধৈর্য হয়ে তৃতীয়বার যেই বেল টিপতে যাবে, অমনি সীমাদি দরজাটা খুলল।
“খুব ভাল সময়ে এয়েচ গো মিষ্টিদিদি। দেক দেকি তোমার বোনঝি কী কাÐটাই না করচে!”
“কেন গো, কী হল আবার?” সীমাদির উত্তরের জন্যে না দাঁড়িয়ে হাতের ছোট ব্যাগটা সোফার ওপর রেখে ভেতরের দিকে পা বাড়াল ও। ফ্ল্যাটের গেস্টরুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মুসুন। মুখটা হাঁ, চোখটা বন্ধ, গাল দুটো টুকটুকে লাল। জোর কান্নার পর্ব চলছে। হাত পা দুটোই এলোমেলোভাবে ছুড়ছে ও। খুব জোরে কাঁদলে মুসুনের মুখ থেকে আওয়াজ বেরোয় না। এখন সেই পরিস্থিতি। ওর মা হাতে একটা বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মেঝেতে চামচ আর কিছু একটা খাবার পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। খাবারটা দেখে নিতান্তই স্বাদগন্ধহীন বলে বোধ হচ্ছে। দিদির মুখের দিকে না তাকিয়েই মিষ্টি বুঝল যে আরেকপ্রস্থ বকুনি আসতে চলেছে মুসুনের দিকে। এক দৌড়ে ঘরে ঢুকে মুসুনকে কোলে তুলে নিল ও।
“কে মেরেছে, কে বকেছে, কে দিয়েছে গাল?
তাই তো মুসুন রাগ করেছে, ভাত খায়নি কাল!”
একই ছড়া দু’বার বলতেই কান্না পুরো ভ্যানিশ। প্রথমে মুখের অমাবস্যা পাল্টে একটা অবাক ভাব এল। ওর লাল টুকটুকে দুটো গালে এরপরে দুটো হামি দিতেই ফোকলা দাঁতের জোৎস্না ফুটে উঠল।
“জানো মাছিমণি, আমি না কিচ্চু করিনি।”
“উঁউউউ, উনি কিছুই করেননি! খাবারে একটু নুন, মশলা কম হলেই ওনার মুখে নাকি রোচে নাৃ” মুসুনের মা গর্জে উঠল।
“আমি ম্যাগি খাব, মাছিমণিৃ”
“না; মা যেটা দিয়েছে সেটা বেশ ভালো খেতে। আমি ছোটবেলায় খুব ভালবাসতাম। আলুসেদ্ধ আর ডিমের সাদা, তাতে একটু নুন, আর একটু মরিচ।”
“মলিচ দেয়নি মা।” মুসুনের ঠোঁটটা অভিমানে ফুলে গেল একটু।
“তা বলে বাটিতেই মুখ থেকে ওয়াক তুলবে!” মায়ের মুখও একইরকম লাল। “তারপর যেই কান ধরেছি, অমনি বাটি আর চামচ ছুড়ে ফেলে দিল! পুরো উচ্চিংড়ের মতন লাফাচ্ছিলৃ”
“উচ্চিংলে কী মাছিমণি? আমি কি দেখেছি?”
“না দেখলে কী হবে, ওদের মতোই তো লাফাতে শিখেছ! দেখলে আরও কত না লীলা দেখতে হত।” মাসি কোনও উত্তর দেওয়ার আগে মা দাঁত কিড়মিড় করে উঠল।
“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়ে গেছে। মা আরেকবার মরিচ দিয়ে করে নিয়ে আসছে, আমি বরং এই ফাঁকে তোমায় একটা গল্প শোনাই।”
“কীসের গল্প?”
“আগে তোমার মুখটাতে একটু জল দিই। পুরো ঘেমে গেছ।”
“ইস্টার্ন আমেরিকার একটা জঙ্গল, সেখানে সবে হাড়-কাঁপানো শীত পেরিয়ে বসন্ত এসেছে। যেসব গাছের পাতাগুলো সব খসে গেছিল, তাদের গায়ে এখন কচি পাতার ঢল নেমেছে। ডালে ডালে পাখি গাইছে। অনেকের ডিম ফুটেছে, মুসুনের মতন ছোট্ট ছোট্ট সুইট বেবিরা বাসায় কিচিরমিচির করছে খাবারের জন্য।ে মা বাবারা তাদের ডিনার খাইয়ে শুইয়ে দিচ্ছে, কারণ সন্ধে নামছে আস্তে আস্তেৃ”
“মাসিমণি গল্প বলছ? আমিও শুনব।” টুকুন খেলা শেষ করে এই সবে বাড়িতে ফিরে এসেছে।
“নিশ্চয়ই শুনবে। আগে গা হাত-পা ধুয়ে এস।”
মিষ্টির গায়ে গা লাগিয়ে মুসুন বসল বিছানায়। টুকুন হাত-পা ধুয়ে এসে বসে পড়ল সামনের রকিং চেয়ারে।
“জঙ্গলে তো আমাদের বাড়ির মতন টিউব বা বালব থাকে না, তাই সন্ধে হতে না হতেই তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসে চারদিকে। সেদিন দেখা গেল অন্ধকার হতেই জঙ্গলের মেঝে, মানে মাটি ফুঁড়ে এক ধরনের ছোট ছোট পোকা বেরিয়ে এল। প্রথমে কয়েকটা, তারপর হাজারে হাজারে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কোটি কোটি ওরকম পোকা দেখা গেল সোলজারদের মতন মার্চ করে এগোচ্ছে বড় বড় গাছেদের দিকে। এরা সবাই মাটির তলায় ছিল অনেক অনেক বছর।
“কত বছর মাসিমণি?” টুকুন স্যান্ডউইচে একটা কামড় দিয়ে টুকরোটা মুখে নিয়ে জিগ্যেস করল।
“সতেরো বছর!”
“স-তে-রো বছর! পোকারা এত বছর বাঁচে নাকি?”
“ভেরি গুড টুকুন! তুমি দশ বছর বয়সে যা জানো, আমি তো কুড়ি বছর বয়সেও তা জানতাম না! পোকারা সাধারণত খুব বেশি হলে দু’বছর বাঁচে। তবে এই পোকারা সতেরো বছর অবধি বাঁচে। পোকাদের মধ্যে এটা একটা রেকর্ড। এই ব্যাপারে আর কেউ এদের ধারেকাছে আসে না। এদের চোখগুলো লাল, শরীর কালচে। আকারে প্রায় এক থেকে দেড় ইঞ্চি হয়, এই সাইজের –” মিষ্টি ওর আঙুলের একটা অংশ দেখিয়ে বলল।
“এই পোকার নাম কী মাছিমণি?”
“এদের বলে পিরিওডিক্যাল সিকাডা। আমেরিকানরা উচ্চারণ করে ‘সিকেডা’। এরা এক ধরনের উচ্চিংড়ে।”
“উচ্চিংড়ে এত্ত দিন বাঁচে কী করে? ওদের তো পাখি বা জঙ্গলের অন্য প্রাণীরা খেয়ে নেবে?” টুকুনের গলায় এবার পরিষ্কার অবিশ্বাস।
“সব উচ্চিংড়ে বা সিকাডারা কিন্তু বাঁচে না এতদিন। অ্যানুয়াল সিকাডারা এক থেকে পাঁচ বছর অবধি বাঁচে। সেগুলো আমাদের দেশ বা অন্যান্য গরম দেশে দেখা যায়। কিন্তু পিরিওডিকাল সিকাডা উচ্চিংড়েদের মধ্েয একধরনের স্পেশাল প্রজাতি। এদের আবার অনেকগুলো ব্রæড হয়। একেকটা ব্রæড ইস্টার্ন আর মিড ওয়েস্টার্ন আমেরিকার একেকটা অঞ্চলে থাকে।”
“তারপর সোলজাররা কী করল? মুসুন আরেকটু গা ঘেঁষে বসল মিষ্টির।
“এই অবস্থায় সিকাডাদের বলে নিম্ফ। গায়ে কোনও ডানা নেই, তাই উড়তে পারে না। এদের সবারই বয়স সতেরো। এদের জন্ম হয়েছিল ওদের মা ডিম পাড়ার ছয় থেকে দশ সপ্তাহ বাদে। ডিম ফুটে এরা বেরোনোর পরেই এরা চলে গেছিল মাটির অনেক নীচে। সেখানে বিভিন্ন বড় বড় গাছেদের শেকড়ে বাসা বেঁধেছিল দলে দলে। সেখানে কোনও বিপদ নেইৃ”
“কীসের বিপদ?”
“এদের খায় এমন অনেক অনেক পশুপাখি আছে— যেমন ধর, বিভিন্ন রকমের পাখি, কচ্ছপ, টিকটিকি, কাঠবিড়ালি, এমনকি একটু বড় বড় পোকা যেমন মাকড়সা, ম্যান্টিস। কিন্তু এরা কেউই মাটির নীচে যেতে পারে না। তাই মাটির নীচে সিকাডারা নিশ্চিন্তে কাটায় জন্মের পরের সতেরো বছর। অবশ্য কিছু কিছু তেরো বছরের ব্রডও আছে। এদেরকে তেরো বছর বাদে দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বড় ঝাঁক হল ব্রæড টেন, এদের সতেরো বছর বাদে দেখা যায়। ২০২১-এর পর এরা আবার দেখা দেবে ২০৩৮-এ।”
“এ বাবা, এতদিন অপেক্ষা করতে হবে!” টুকুন একটু হতাশ হল।
“২০২৪-এ বেরোনোর পালা ব্রæড থার্টিন আর নাইনটিন’দের। বসন্তকালে যখন টেম্পারেচার আঠারোর আশেপাশে থাকে।”
সীমাদিকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে একটু থামল মিষ্টি।
“তোমার খাবার এসে গেছে মুসুন, হাঁ করো দেখিৃ”
মুসুন হাঁ করে মুখ খোলার আগে চট করে জিগ্যেস করে নিল, “তারপর ওরা কী করল মাছিমণি?”
“তারপর, ওরা বড় বড় গাছের গুঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। আগেই তো বলেছি— একটা নয়, দুটো নয়, দশটা নয়, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি সিকাডা। এত বেশি যে, সব গাছের গুঁড়ির রং পাল্টে গেছে মনে হয়। অনেক ওপরের ডালে উঠে ওরা এবার নিজেদের ড্রেস পাল্টায়। বাইরের শক্ত খোলসটা পিঠের জায়গা থেকে ভেঙে যায়, ওদের নরম সাদাটে শরীর বেরিয়ে আসে বাইরে। প্রত্যেকেরই ডানা হলদেটে কিন্তু একদম ট্রান্সপ্যারেন্ট— এধার থেকে ওধারে দেখা যায়। তবে সে ডানার কোনও জোর নেই, কারণ সেগুলো তখনও শক্তপোক্ত হয়নি। ওরা এবার ডালে পিঠ ঝুলিয়ে বসে থাকে সারারাত। ওভাবেই রাতটা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়। ভোরবেলায় ডানা একদম শক্ত— যতখুশি ওড়ার জন্যে একদম রেডি।”
গল্প শোনানোর মধ্যইে বেশ কয়েক চামচ খাবার মুসুনের মুখে চালান হয়ে গেছে।
“সকাল হতেই দেখা গেল এরা জঙ্গলের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এদের গায়ের রং ততক্ষণে কালচে হয়ে গেছে, চোখদুটো টকটকে লাল, ডানা দুটো হলদে। গায়ের নরম মাংসের ওপর আবার একটা শক্ত খোলস দেখা দিয়েছে। পেটের তলা থেকে তাতে ডোরাকাটা দাগ।”
“বাঘের মতন ডোরাকাটা?”
“ঠিক বলেছ সোনা বেবি।”
“আমাকে একদিন বাঘের বেবির গল্প বলতে হবে কিন্তুৃ”
“দাঁড়া না, সেটা তুই পরে শুনিস। আগে সিকাডাগুলো কী করল সেটা শুনি।” টুকুন একটু বকেই দিল বোনকে।
“এতদিন এরা মাটির তলায় থেকেছে। খালি শেকড়ের ভেতরের যে জল— মানে একরকম গাছেরই প্ল্যান্ট স্যাপ খেয়ে এসেছে। এখন এই সব টিনএজারদের দেখে কে! সুন্দর রোদ, ঝলমলে ওয়েদার, চারদিকে প্রচুর খাবার। এরা ভিড় করল ছোট ছোট ফল বা বেরির মতন গাছে। খাওয়ার সাথে সাথে চলল ছেলেদের কোমর দুলিয়ে নাচ। কিন্তু সে নাচ যত না দেখার, তার থেকে বেশি শোনার।
“মানে? নাচ আবার শোনা যায় নাকি?”
“এদেরটা যায়। সে এক সাঙ্ঘাতিক জোরালো আওয়াজ। প্রায় নব্বই ডেসিবেল। মেশিন চলার মতন। ওদের কোমরে শক্ত খোলার মতন যে চামড়া থাকে, সেটাকে টিম্বাল বলে। এই টিম্বাল সেকেন্ডে একশো থেকে পাঁচশ’বার পর্যন্ত নাচিয়ে এরা এই অসম্ভব জোর আওয়াজ করতে থাকে। আর মেয়েরা এর উত্তরে কী করে জানো?”
“কী করে?” মিষ্টির বাঁ হাতের তালুতে মুসুন নিজের ডানহাতের তালুটা রাখল। মিষ্টি ওর মুখে খাবারের শেষটুকু গুঁজে দিল।
“ওরা উত্তরে একটা তুড়ি দেওয়ার মতন আওয়াজ করে ডানা ঝাপটে। মজার ব্যাপার হল, ওরা যখন বেরোয় তখন যদি কেউ লন মোয়ার চালায়, মেয়ে সিকাডারা তাকে ছেঁকে ধরবে। লন মোয়ারের আওয়াজ ঠিক ছেলেদের টিম্বাল নাচানোর আওয়াজের মতন। আর যদি তুমি একটা ছেলে সিকাডার সামনে তুড়ি দাও, তাহলে সে তোমার হাতের দিকে আসবে।”
“কী মজা!” হাততালি দিয়ে উঠল মুসুন।
“এইসময় আসল মজা কাদের হয় জানো?”
“কাদের মাসিমণি?” টুকুন মাথা চুলকে বলল।
“এই সিকাডারা খুব নিরীহ। কামড়ায় না বা হুল ফোটায় না, অন্য পোকাদের মতো। খুব বেশি উড়তেও পারে না। অথচ খাবার হিসেবে এরা দারুণ টেস্টি। তাই বিভিন্ন প্রাণীদের মধ্যে কম্পিটিশন লেগে যায় এদেরকে খাওয়ার জন্য।ে কাঠবিড়ালি থেকে কচ্ছপ, পাখি থেকে মাকড়সা— সবাই এদের খেতে শুরু করে মহানন্দে। যাকে বলে মহাভোজ— ফিস্ট অফ আ লাইফটাইম!”
“ইশশশ, এত বছর বাদে বেরিয়েই চলে যেতে হল অন্যদের পেটে। তাহলে কী লাভ হল?” এইবার টুকুন রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেছে।
“বাঃ, ভেরি ইন্টেলিজেন্ট কোয়েশ্চেন টুকুন! উত্তরটা খুব সোজা। এইভাবে এত সিকাডা খেয়ে অরুচি ধরে যায় পাখি, কাঠবিড়ালি, কচ্ছপদের। আর একসঙ্গে এতজন এই মহাভোজের কবলে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কিন্তু লাখ লাখ সিকাডা বেঁচে থাকে। তারা তখন ডিম পাড়ে। এক একজন মেয়ে সিকাডা প্রায় পাঁচশো থেকে ছ’শো ডিম পাড়ে। সেই ডিম ফুটে ছানা বেরোনোর আগেই মা-বাবারা মারা যায়। অনাথ বাচ্চারা তাই জন্মানোর পরেই ঢুকে পড়ে মাটির ভেতরে। তার পরের গল্প তো বলেইছিৃ”
মিষ্টির কথাটা শেষ হতে না হতেই জানালা দিয়ে কী একটা পোকা উড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল।
“উচ্চিঙলে, উচ্চিঙলেৃ” মুসুন একটুও ভয় না পেয়ে হাততালি দিয়ে উঠল।
“মাসিমণি, আমেরিকা হলে উচ্চিংড়েটা আমার থেকে বয়সে বড় হত, তাই না?”
টুকুনের কথায় হো হো করে হেসে উঠল মিষ্টি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category
© All rights reserved © 2017 zahidit.Com
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: BDiT